আমরা আমাদের জীবন থেকে বহু কিছুই হারাইছি যার বেশিরভাগই আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ-
কলম হারাইয়া গেলে আমাদের আব্বা খাতার সাথে কলম সুতা দিয়া বেঁধে দিত।
আমরা কলমের মাথা কামরাইয়া চেটকা বানাইতাম,কলম দিয়া টেবিলে আউট আউট খেলতাম,কলম দিয়া লাঙ্গল বানাইতাম।
আব্বা দিস্তা কাগজ কিনে আনত,ঘরে সুই সুতা থাকতো সেলাইয়ের জন্য।
খাতার পাতা দিয়া শাপলা,বিমান,নৌকা বানাইতাম।
খাতা ও বই সেলাই করে ক্যালেন্ডার এর পাতা দিয়া মলাট লাগাইয়া,
মলাটের উপরে সুন্দর করে বইয়ের নাম,ক্লাস,রোল,আমাদের নাম লিখে রাখতাম।
বর্ষাকালে স্কুলের চালের ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টির পানি পরতো।
গরমের দিনে মাঝেমধ্যেই আমরা বাইরে গাছের নিচে ছালার চটে বসে ক্লাস করতাম ।
স্যারদের সাথে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর বাবা মার কথা হতো,
বাজারে আমাদের দেখলে রাগ দেখাইতো,বাপ মা দের বলতো পোলাপান রে বাজারে পাঠান কেন?
স্কুলটাইম ছাড়া স্যারদের সামনে পরতে চাইতাম না,
সাইকেল থেকে নেমে সালাম দিয়ে চুপচাপ পিছনে সাইকেল নিয়ে হাঁটতাম,
স্যার যখন বলতো চলে যা-যাও তখন কাচুমাচু করে যাইতাম।
আমাদের স্যারেরা খুব মারতো আবার খুব আদরও করতো
স্যারদের বিদায়ে আমরা কানতাম।
আব্বা দুপুরে কুঁপিবাতি পরিস্কার করে পাটের আঁশ দিয়া সলতা বানাইয়া রেডি করে রাখতো,কুঁপিবাতি রাখার জন্য নানান ডিজাইনের বাঁশের গাছা থাকতো।
পিড়িতে বসে ছালার বস্তা বিছিয়ে পড়তাম,
হারিকেন এর সলতে কিনে আনতে হতো ,আব্বা কাচ পরিস্কার করে রাখতো।
সন্ধ্যাই কুঁপিবাতি হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসতে হতো ,
দশটার আগে খাওন নাই।
বহু সংসারে ভাতের অভাব ছিল,
ভাতের মার নিয়া ঝগরা হতো ভাই বোনের মধ্যে,
ভাতের বিকল্প ছিল আটার রুটি, মিষ্টি আলু।
ফুলকপি বাধাকপি মুলা ডাটা,বেগুন বাজারে ফেলে চলে যেত কৃষকেরা।
তিরিশ হাজার টাকা দিয়া বড় ষাঁড় গরু কেনা যাইতো।
আব্বার পুরান সাইকেল নিচে থেকে শিখে অনেকদিন চালানোর পর হটাৎ উপরে উঠে পরে নামতে পারি না ,
সাইকেল দিয়ে স্কুলে যাওয়া,বাজারে যাওয়া, আব্বা বাজার করে দিবে নিয়ে আসা,
সাইকেল নিয়ে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া সাথে শার্ট প্যান্ট কেনা ।
চাঁদনী রাতে চোরপুলিশ, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছোট,পাক্কা,এম্পিলিছ খেলা।
ভরদুপুরে নৈ,ডাংগুলি,সাতচারা,বোম্বাস্তিক,এপেন্ডোবাইস্কোপ,কিতকিত
,এক্কাদুক্কা খেলা।
সাইকেলের শিক আর ম্যাচের বারুদ দিয়ে বোমা ফাটানো,রশুন বোমা ফাটানো।,
হাপ্পা,চিল্যা,দর ঘুট্টি উড়ানো কারটা কতটুকু উঠছে এই প্রতিযোগিতা।
টায়ার খেলা,রিং খেলা,বেয়ারিং এর তিন-চার চাকার গাড়ি বানানো,সুপারি গাছের খুল দিয়ে গাড়ি খেলা,ফুলা দিয়ে মাছ বানানো,কল বানানো,বাঁশ দিয়ে ধনুক তীর বানানো,চরহি খেলা,লাড্ডুম খেলা,,কাগজে লুডু খেলা,কেরাম খেলা,ভিডিও গেম খেলা কয়েন দিয়ে,আরো কতকত নাম না জানা খেলা।
পুকুরে সাঁতার কাটা,নল খেলা,চোখ লাল হয়ে যাওয়া,
কলা পাতা দিয়া ঘর বানানো,বউ জামাই খেলা,চুলাপাতি খেলা,
চোখের পাতা উল্টায়ে ভয় দেখানো খেলা, ইদের সময় মার্বেল খেলা,
দশটাকা বিশ টাকা দামের কাচের আয়না-সাবান দিয়া বাজি ফুটবল,ক্রিকেট খেলা।
এক কেজি হাফ কেজি গোলগোইল্যা দিয়া ভলিবল বাজি খেলা,
হাডুডু খেলা,বেডমিন্টনের ঘর কাটা।
মার্চ মাসে আশেপাশের সব এলাকাতে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান হইতো।
আমরা দৌড় লাফ খেলায় অংশগ্রহণ করতাম, একসাথে বিশ বাইশ জন দল বেঁধে যাইতাম, পুরষ্কার আট দশটা আমাদের থাকতো।
রাতে মঞ্চ নাটক হতো,নাটকে অভিনয় করতাম,দুই তিন মাস রিহার্সাল হতো ।
রাতে নাটক-বাপ চাচা, গ্রামের মহিলারাও দেখতো আমাদের সামাজিক নাটক কাচের পুতুল অথবা মাতৃঋণ শোধ ।
আত্মীয় স্বজন আসতো,
মেলার মত দোকান বসতো, আমরা প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতাম অনুষ্ঠান সফলভাবে করার জন্য।
আশেপাশের এলাকায় যাত্রা শুরু হলে দল বেঁধে দেখতে যাইতাম।
একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে শহীদ মিনার বানাইতাম কলাগাছ দিয়ে,
মাইক ভাড়া করে দেশাত্ববোধক গান বাজানো হতো,
রাতে ফুল চুরি করা মিনার সাজানোর জন্য,
আশেপাশের কোন বাড়িতে ফুল থাকতো না,
অনেকেই টের পাইতো- বলতো সবগুলো নিয়ো না ।
ডাব চুরি, খাইতাম ভালো না লাগলে গোসল ডাবের পানি দিয়া,
মুরগি চুরি করে বিরানি,খেজুর রস ,তালের তারি,কচি তালের শ্বাস।
মসজিদের শিন্নি জিলাপি খাওয়া।
বর্ষার রাতে বাঁশ দিয়ে বানানো গোল অথবা লম্বা মাথাল মাথায় দিয়ে বদনি বাতি হাতে নিয়ে মানুষ চলাচল করতো,রাস্তাঘাট কাচা ,কাদা ,পিচ্ছিল, থাকতো।
আমরা আতলা বিলে মাছ ধরতে যাইতাম সকালে ,ছোট পুটি ,চিরকা,বৈট্যা,টাকি মাগুর কৈ মাছ নিয়ে সন্ধ্যাই ঘরে আসলে আমাদের আম্মা বলতো তরে কে বলছে মাছ ধরতে!
রাতে এই দেশি মাছের সালুন দিয়া ভাত খাওন।
বিছান জাল নিয়া কোদালিয়া গাঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া হত দল নিয়া।
রেডিও তে গান খবর শুনা, টেপ রেকর্ডারের ক্যাসেট কিনা,ফিতা আঙ্গুল দিয়ে ঘুরানো,
কারেন্ট ছিলো না,ঠেলাগাড়ি দিয়ে ব্যাটারী চার্জ করতে নিতে হতো বাজারে , দুইদিন চার্জ হলে অনেকদিন টিভি দেখা যেতো।
লম্বা বাঁশের মাথায় এন্টিনা লাগানো থাকতো,টিভি ঝিরঝির করলে আমরা বাইরে বের হয়ে এন্টিনা ঘুরাইতাম,
ঘর থেকে একজন বলতো হয়ছে হয়ছে আরেকটু আরেকটু ডানদিকে হ হ ঠিক আছে ।
বিটিভি চ্যানেলে
আলিফ লাইলা, সিনবাদ,শুক্রবারে বাংলা সিনেমা দেখতাম।
বিজ্ঞাপনের সময় টিভি বন্ধ, চেয়ার, জলচৌকি,মুড়া,পাটি,মাটিতে ঘর ভরা ছিল দর্শকে, কেউ কেউ সিনেমা দেখে কানতো,গোপনে চোখের পানি মুছতো, কেউ দেখে ফেললে লজ্জিত ভাব।
দুই টাকা টিকিটে বাজারে সিডিতে বাংলা সিনেমা দেখা,
সিডি টিভি ভাড়া করে এনে বাড়ির সবাই মিলে নতুন সিনেমা দেখা ।
গরু-মহিষ দিয়ে হালচাষ করা হত ,যারা এই কাজ করতো তারা গরুরে তাড়া দিত থেটথেট হুশহুশ,হাইটহাইট করে।
জমিতে পানি দিতাম কেরোসিন তেলের সেচে।
আমাদের মা চাচিরা ধান দিয়ে বগনি বানাইতো, টক জাতীয় খাবার।
বেশি খাইলে মাথা হালকা ঘুরাইতো।
ধান দিয়ে তেল,শুটকি,বাদাম,তকতি রাখা হতো।
ধান কাটার পর কামলা ধান বাইরাইতো পরে গরু দিয়া মাড়ানো হতো,
খড়ের গাদাতে ঘর বানিয়ে পলান্তি খেলা হতো।
রাতে আগুন তাপানো হতো পরিবারের সবাই মিলে,
বড় আগুন ধরানো হতো ,আশেপাশের বাড়ির ভাই চাচারা আসতো আগুন তাপানোর জন্য,আলু ,বেগুন পুরোনো হতো ভর্তার জন্য,মেরা পিঠা পোড়ানো হতো। খড়ে থাকা ধান আগুনের তাপে খই হতো আমরা একটা একটা করে জড়ো করে হিসাব করতাম কার কয়টা হইছে,
বাড়িতে চালের মুড়ি ভাজা হত।
দুধচিতই,চিত্যা পিঠা,কলা পিঠা,মলপিঠা, পোয়া পিঠা, আতলুডি পিঠা,হিদল পিঠা,ঝাল পিঠা সহ আরো নানা জাতের পিঠা বানানো হত।
মুরুব্বিরা ডাবা-তামুক খাইতো ,পুঁথি পাঠ করতো ,
পালা গান, বাউল গান,গাজির গানের আসর হইতো।
বাইদ্যা পুরুষ মহিলারা সাপের খেলা দেখাইয়া চাল তুলতো তাবিজ বিক্রি করতো,
চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হইতো,
দেখা সাক্ষাত কম হতো মনের যোগাযোগ ছিল সুন্দর।
এইসব আর নাই আমাদের জীবন থেকে হারাই গেছে।
আমাদের সব হারাই গেছে।
সফুল আকন্দ